This is this sidebar for a particular page. It can be edited by editing a page from within the control pannel.
বাবিলের উঁচু দালানঃ মানুষের গর্ব ও সৃষ্টিকর্তার বিচার
কি হয় যখন মানুষের উচ্চ আকাঙ্ক্ষার সীমা ছাড়িয়ে যায়? যখন মানুষের একতা রুপ নেয় অহংকারের? মানুষের উচ্চ আকাঙ্ক্ষা যখন ঈশ্বরকেন্দ্রিক না হয় তখন তাদের এই একতার পরিণতি কি? বাইবেলে আমরা এমনই এক ঘটনা আমরা দেখতে পাই যেখানে মানুষের অহংকার ও নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে গড়ে তোলা একতা তাদের অন্ধ করে দেয়।
বাবিলের উঁচু দালান
আদিপুস্তকের ১১তম অধ্যায়ে বর্ণনা করা বাবিল নগরের উৎপত্তি এবং পতন আমাদের মনে করিয়ে দেয় মানুষ যতই সংঘবদ্ধ থাকুক না কেন যদি তারা ঈশ্বরের দেওয়া উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে নিজেদের মনগড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে, তবে সৃষ্টিকর্তা তার সঠিক বিচার স্থাপন করবেন।
ঘটনার প্রথমার্ধ (আদি ১১ঃ১-৪) মানুষের কার্যক্রমের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করে। এরপরের অংশ মানবজাতির প্রকল্প পরিদর্শনের জন্য ঈশ্বরের নেমে আসা ও তাঁর সিদ্ধান্তের দৃশ্য বর্ণনা করে (আদি ১১ঃ৫-৯)। সৃষ্টিকর্তার এবং মানুষের প্রতিক্রিয়া স্পস্টভাবে বিপরীতমুখী দেখা যায়।
বন্যার বেশ কিছু সময় পর নোহের বংশের লোকেরা পূর্বদিকে যাত্রা করে এবং শিনার নামক অঞ্চলে সমভূমিতে বাস করতে থাকে। একতাবদ্ধ হয়ে লোকেরা সেখানে একটি নগর ও উঁচু এক দালান তৈরি করার প্রস্তাব করে যেন তাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা (আদি ৯ঃ১) অনুযায়ী তারা নিজেরা ছড়িয়ে পড়তে অনিচ্ছুক (আদি ১১ঃ৪)। ঈশ্বর তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেন এবং জানেন যে এক ভাষায় যোগাযোগের কারনে তারা যেকোনো কিছুই করতে সক্ষম হবে যেগুলো হবে ঈশ্বরের ইচ্ছার পরিপন্থি, তাই ঈশ্বর তাদের ভাষাকে বিভ্রান্ত করেন। এতে তারা একে অপরকে বুঝতে পারে না। সৃষ্টিকর্তার এই হস্তক্ষেপ তাদেরকে পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার দিকে নিয়ে যায় এবং কার্যকরভাবে তাদের নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ করে দেন। কিন্তু কেন ঈশ্বর এই সমভূমিতে নগর ও উচু দালান তৈরি করার প্রকল্প থামিয়ে দেন এবং মানবজাতিকে বিভক্ত করেন ভাষায় বৈচিত্র্যতা এনে দিয়ে?
কেবল দালান? যিগুরাট নাকি মন্দির?
বহু প্রাচীন মেসোপটেমিয় প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ধারণা করে থাকেন যে বাবিলের সেই উঁচু দালানটি হতে পারে একটি প্রাচীন সুমেরীয় “যিগুরাট”। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ রবার্ট জোহান কোল্ডেওয়ে এবং ওয়ালটার আন্দ্রে স্ট্র্যাটিগ্রাফি এবং স্থাপত্যের উপর গুরুত্ব দিয়ে একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। কোল্ডেওয়ে আধুনিক তুলনামূলক প্রত্নতাত্ত্বিক কৌশল ব্যবহার করে প্রায় ১৫ বছর ধরে ব্যাবিলনের খনন কাজ চালিয়ে যান এবং ১৯১৩ সালে বাবিলের উঁচু দালান বা যিগুরাটের ধ্বংসাবশেষ আবিস্কার করেন। যিগুরাটটির উচ্চতা আনুমানিক ২৫০ফিট এবং এর তিনটি সিঁড়ি রয়েছে যা বিভিন্ন ব্যাবিলনীয় দেবতাদের জন্য উৎসর্গ করতে উপরের দিকে নিয়ে যায়।
প্রাচীন ব্যাবিলনীয়রা আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করা ইট এবং আলকাতরা দিয়ে তৈরি করা দালানকে “যিগুরাট” বলে চিনত। “যিগুরাট” শব্দটি আসে সেমিটিক আক্কাদিয়ান ভাষা “𒅆𒂍𒉪/ য্যিকুরাতাম” থেকে যার অর্থ “উচ্চগামী দালান”। এই ধরনের মন্দির দালান প্রাচ্যের মিশরীয় পিরামিডের সমতুল্য এবং ঠিক ততটাই পুরানো। যদিও পিরামিডের মত যিগুরাট কোনো সমাধি ছিল না। যিগুরাট প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার অনেক শহরের ধর্মমতে বিশেষ ভুমিকা পালন করত। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস যিগুরাটের চূড়ায় প্রধান মন্দিরের মধ্যে জমির উর্বরতার জন্য রিচুয়াল করার কথা বর্ণনা করেন।
প্রত্নতত্ত্ববিদেরা প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার ১৬টি শহরে ১৯টি এরকম স্থাপনার আবিস্কার করেছেন। আরো ১০টির অস্তিত্ব সাহিত্যের মাধ্যমে সূত্রপাত হয়।
বাবিলের এই যিগুরাটের নাম ছিল “ 𒂍𒋼𒀭𒆠 বা এটেমেনানকি” যার অর্থ “স্বর্গ ও পৃথিবীর ভিত্তির মন্দির”। ব্যাবিলনীয় সৃষ্টির মহাকাব্য “এনুমা এলিস” অনুসারে দেবতা মারডুক অন্যান্য দেবতাদেরকে দানব তিয়ামাতের বিরুদ্ধে রক্ষা করেছিলেন। যখন মারডুক জগতে শৃঙ্খলা নিয়ে আসে তিনি তিয়ামাতকে হত্যা করে এবং ইসাগিলা তৈরি করেছিলেন, যা ছিল নতুন বিশ্বের কেন্দ্র এবং সৃষ্টি করেছিলেন মানবজাতিকে। এই ইসাগিলার পাশেই ছিল এটেমেনানকি নামক যিগুরাট। এর মানে হল এটেমেনানকি মন্দির-দালানটি বিশ্বের কেন্দ্রে তৈরি করা হয়েছিল মহাবিশ্বের অক্ষ হিসেবে। রুপক হিসেবে বলা যায়, একটি সরল রেখা পৃথিবী এবং স্বর্গকে সংযুক্ত করেছে। ব্যাবিলনীয় সৃষ্টিতত্ত্বের এই দিকটি বাইবেলের ঘটনাতেও প্রতিধ্বনিত হয়, যেখানে বাবিলের দালানটির নির্মাতারা বলেছিলেন, “আইস, আমরা আপনাদের নিমিত্তে এক নগর ও স্বর্গস্পর্শী এক উচ্চগৃহ নির্মাণ করিয়া আপনাদের নাম বিখ্যাত করি” (আদি ১১ঃ৪)।
লোকেদের গর্বঃ স্বর্গে পৌঁছানোর ইচ্ছা?
একদিকে, একতা সবারই কাম্য কারন মানুষের সহযোগিতা অবিশ্বাস্য সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম। অন্যদিকে, পাপপূর্ণ উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যে একতা ধ্বংসাত্মক ফলাফলের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ইতিহাসজুড়ে বিভিন্ন স্কলাররা “আকাশে দালানের চূড়া” থেকে মানবজাতির এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য এবং অর্থের একটাই চিত্র বেছে নিয়েছেন। বাইবেলের বর্ণিত ঘটনায় প্রথমেই দালানটির কথা উল্লেখ নেই বরং ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সকল মানুষের ভাষা এক । বর্ণনাকারী এই এক ও অভিন্ন বিষয়েঃ “এক ভাষা” প্রথমেই দুইবার পুনরাবৃত্তি করেন (আদি ১১ঃ১)।
যদি চিন্তা করে দেখি কেন নোহের বংশের লোকেরা এই উঁচু দালানটি তৈরি করার চেষ্টা করে তাহলে ভেবে নিতে হবে তারা ঈশ্বরের চুক্তি ভুলে গিয়েছে অথবা তারা পুনরায় কোনো মহাবন্যা থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ঈশ্বর তাঁর চুক্তি ধরে রাখবেন কিন্তু মানুষ সেই চুক্তির প্রতি ভরসা রাখে নি বরং নিজেদের মধ্যে সুনাম পাবার জন্যে উঁচু মন্দির-দালান তৈরি করা শুরু করে যেন তাদের ছড়িয়ে পড়তে না হয়। ঈশ্বর নিজেই নেমে এসে তাদের ভাষার পরিবর্তন করেন যেন লোকেরা একে অপরকে বুঝতে না পারে। এতে বিভেদের কারনে সেই বাবিল থেকে লোকেরা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে। সৃষ্টিকর্তা তাদের ভাষা পাল্টে দিয়ে মানবজাতির ভাষার ইতিহাসকে দীর্ঘায়ু দেন।
মানুষের গর্বের পরিণতি ঈশ্বরের শাসন এবং ঈশ্বরের শাসন তাঁর উদ্দেশ্যের বিপন্থি নয়। সৃষ্টিকর্তা যখন বিভেদ তৈরি করেন তখন তাঁর দয়া প্রকাশ পায় কারন তিনি আগের মত বন্যায় মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করেন নি। মানবজাতির নিজেদের সুনাম পাবার ইচ্ছা থেকে বরং সৃষ্টিকর্তার আদেশের প্রতি নির্ভরতাই আনতে পারে প্রকৃত কল্যান এবং গৌরব।
বাইবেলের বাবিলের এই পতন এক অংশে বাবিলের সত্য ধর্মের উপহাস করে, অন্যদিকে এটি নিশ্চিত করে যে ভাষা ও সংস্কৃতিতে জাতিগুলির মধ্যে বিভাজন মানুষের গর্বের প্রতি ঐশ্বরিক বিচার.